সূচকীয় বৃদ্ধি
প্রশ্ন হচ্ছে, সূচকীয় বৃদ্ধি- স্বাভাবিক নাকি অতিপ্রাকৃতিক ?
Pareto
Principle, Zipf’s Law , Price’s Law , Metcalfe’s Law , Moore’s Law – এমন বেশ কঠিন কিছু গাণিতিক যুক্তির নাম বলাই যায় , যেসব
নীতি পৃথিবীর ঘটনাবলীতে সূচকীয় গাণিতিক সম্পর্ককে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ফেলে। কেন আত্মোন্নয়নের
বইগুলোতে
80/20 Principle এর জোড়গলায় আলোচনা হয় ? কেন মানুষ তেলা মাথায় তেল দেয়া পছন্দ
করে ? কেন মাইক্রোসফট ২০০২ সালে জানায় যে, তাদের বেশিরভাগ (প্রায় ৮০%) ম্যালফাংশন
এর জন্য অল্পকতক (প্রায় ২০%) কম্পিউটার
ভাইরাসই দায়ী ? কেন ইংরেজি ভাষায় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত শব্দের ১/২ বার ২য় সর্বোচ্চ এবং এর ১/৩ বার ৩য় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত
হয়েছে ? আর হ্যা , কোভিড-১৯ কেন এক্সপোনেনশিয়ালি গ্রো করে ?
![]() |
| Figure 1: Frequency of Words (Collected from wordcount.org) |
![]() |
| Figure 2 : Frequency of Words (Collected from chegg.com) |
এবার আসা যাক
, Price’s Law তে । একদম
সহজ ভাষায় কোন কোম্পানি তে ১০০ জন কাজ করলেও প্রায় অর্ধেক রেজাল্টই আসে ১০০ এর বর্গমূল
অর্থাৎ ১০ জনের কাছ থেকে । ১০০০ জনের কোম্পানি
হলে ১০০ জনই আপনার অর্ধেকটুকু করে দেয়। এজন্যই ৪-৫ জনের একটা স্টার্ট আপ এ শুরুতে সবা্র ইফোর্ট যেভাবে চোখে পড়বে , কোম্পনি স্কেল আপ করলে অনেককেই তখন মনে হবে নিষ্কর্মা । “ অমুক তো আমার চাইতে ভালই কাজ পারে
; আমার আর হুদামুদা দৌড়ানোর দরকার কী ? বসে বসে
স্যালারি নিই ” । কে জানে এমন মনোভাবই
Mathematical Modeling এর আওতায় চলে আসলো কিনা । একটি
১০০ মানুষের জন্য প্রদত্ত কাজের Price’s Model হবে এমনটাই,
আরেহ Pareto
Principle ? Self-help বই আর একটু-আধটু মোটিভেশনাল
স্পীচ শুনে থাকা প্রায় সবারই হয়তো অনেকের জানা এই 80/20 Principle এরই আরেক নাম
Pareto Principle । প্রায় ৮০% ঘটনার জন্য ২০% কারণই মূলত দায়ী থাকে। সেটা
পরীক্ষায় কোন চ্যাপ্টার থেকে বেশি প্রশ্ন আসে সে-ই এনালিসিস হোক অথবা অল্প কিছু
ধনীর কাছে জিম্মি থাকা পুঁজির পাহাড়ই হোক।
![]() |
| Figure 3: Price's Law Model for 100 Employee (Collected from dariusforoux.com) |
Metcalfe’s
Law মূলত নেটওয়ার্ক এবং কমিউনিকেশন্স
সিস্টেম নিয়ে গড়া একটি গানিতিক রূপ যেখানে বলা হয় কোন একটি নির্দির্ষ্ট নেটওয়ার্কের
গুরুত্ব বা মূল্য বা প্রভাব তার ব্যবহারকারীর বর্গের সমানুপাতিক। ৩ জন
গ্রাহক কে নিয়ে কার্যক্রম চালানো কোন নেটওয়ার্কের মূল্য ৯ একক হলে , ৫ জন গ্রাহক আসলেই তা হয়ে যাবে ২৫ একক , আরো ৫ জন যোগ
করুন , আপনার নেটওয়ার্ক এর ভ্যালু ১০০ এককে পৌঁছে যাবে।
Figure 4: Pareto Principle graphical representation (Collected from mytimemanagement.com and betterexplained.com)
বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার ইউজার এনালিসিসে
এই অনুকল্পের বাস্তবিকতা মিলে যায়। বর্তমানে বিটকয়েনের মূল্য অনুমানেও এই
মডেল অনেকেই ব্যবহার করেন। বেশ কয়েকবছর
ধরে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া সাইটের ব্যবহারকারী এবং সেই সাইটের হিট সেশন বা কত সময়
ধরে গ্রাহকেরা সেই সাইটে ছিলেন সেই তথ্য থেকেই এই অনুকল্পের সাফল্য বোঝা যায়।
Figure 5: Metcalfe’s Law graphical representation
(Collected from ondigitalmarketing.com)
এরকম প্রতিটি গানিতিক মডেলে আমরা
দেখি কীভাবে প্রকৃতিতে এই সূচকীয় সম্পর্ক বিরাজ করে। এই সূচকীয় বৃদ্ধির কারণ এবং সম্ভাবনার ক্ষেত্র নিয়ে ২য় পর্বে
আলোচনা করা হবে। রিসোর্সের স্বল্পতার প্রভাব আর কোভিড-১৯ এর বৃদ্ধির পর্যালোচনাও
থাকছে !
বি.দ্র. গাণিতিক মডেল গুলো নিয়ে অনেক গণিতজ্ঞ বিতর্ক উত্থাপণ করেন এবং অনেকেই বিভিন্ন
মডেল কে অসার দাবি করলেও স্যাম্পল সংখ্যা বাড়লেই অনেকক্ষেত্রে মিল পাওয়া যায়,তবুও অনেকক্ষেত্রে সাংঘর্ষিক মনে হতেও পারে।
সূচকীয় বৃদ্ধি -
স্বাভাবিকতার অন্দরে
শর্টকাট
রাস্তা খোঁজা , সহজে কম পরিশ্রমে কিছু একটা করে ফেলার মনোবৃত্তি আমাদের মাঝে খুবই সাধারণ । বারবার উঠে টিভির বাটন না
চাপার জন্য রিমোট কন্ট্রোলের আবির্ভাব , সিঁড়ি বেয়ে উপরে না উঠতে এলেভেটর (লিফট)
এর উদ্ভাবন আর ইদানিং কালে হাতে টাইপ না করে ভয়েস রেকগনিশনের মাধ্যমেই কাজ সেরে
নেয়া – সবই ইঙ্গিত দেয় আমাদের কম শ্রমে বেশি কাজ করতে পারার পরিকল্পনার ব্যাপারে ।
সভ্যতার গঠনে এই আলসেমির গুরুত্ব বেশি বৈ কম নয় ।
মানুষের
আচরণ নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীরা এই আলসেমিকে
নাম দেন “ Cognitive
Miser ” । আলোচনা করা হয় যেকোন সমস্যা
সমাধানের ক্ষেত্রে মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক পরিশ্রমে মানুষ কতটা কিপ্টেমি করতে
পারে। আজকাল কার সময়ে খুব বেশি
ব্রেইনস্টর্মিং না করেই নোট-গাইড দেখে প্রবলেম সলভ , কোন একজনের ইন্টেলেকচুয়াল কাজ
দেখেই তা হুবুহু নিজে করে নেয়া – আমাদের বেশিরভাগেরই স্বভাব ।
এই
কাজের ফলাফল ব্যখ্যা করা হয় “
Principle of Least Effort ” এর মাধ্যমে । গুইলেমো পেরেরোর আবিষ্কার আর জর্জ
কিংসলে জিফ এর বিষদ ব্যখ্যার মাধ্যমে এই
তত্ত্ব গবেষণা জগতে ছড়িয়ে পড়ে যার উপর ভিত্তি করে Zipf’s Law থেকে শুরু করে আরো অনেক
তত্ত্ব নিয়ে হাজির হয়েছেন
গবেষকেরা । “ Principle of
Least Effort ” এ আলোচিত হয় মানুষ বা অন্যান্য প্রাণী বা
এমনকি ভালোভাবে ডিজাইন করা একটি মেশিন কীভাবে সবথেকে কম পরিশ্রমে আদি অবস্থান থেকে
শেষ অবস্থানে যাবে । আর এই কম পরিশ্রমের বা কম বাঁধার পথ অনুসরণ আমরা হরহামেশাই
দেখি। এই তত্ত্বই মূলগতভাবে ১ম পর্বে
আলোচিত নীতিসমূহের “কেন” অংশটি ব্যখ্যা করে।
Zipf’s Law এর ঘটনাটি কেন বেশি ঘটে তা “Brainwash” শব্দটি দিয়েই ব্যখ্যা করি । কাউকে প্রভাবিত করে তার চিন্তায়
মননে কোন বিশেষ চেতনার প্রবেশ ঘটানো হলে আমরা খারাপ অর্থে “Brainwash”
, ভালো অর্থে “Teach” শব্দের ব্যবহার করি। আমাদের মত যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয় , তারা এই দুটো শব্দ দিয়ে কাজ চালিয়ে পছন্দ করলেও , পরিস্থিতির
বিবেচনায় ইংরেজি ভাষায় এদের সমার্থক অন্য শব্দের ব্যবহার বাঞ্চনীয়। কিন্তু আমরা কম পরিশ্রম করে , এই দুটো শব্দ দিয়েই কাজ সেরে ফেলি । এই দুটো শব্দের ব্যবহারের তুলনায়
indoctrinate , imbue , drill into , hammer into , train এই শব্দের
ব্যবহার খুবই কম , একেবারেই নগন্য। সেখানে inculcate শব্দটি দেখা যাবে ব্যবহারই
হয়না । এই ঘটনা কেবল বিদেশি ভাষায় নয়
, নিজেদের ভাষায়ও এই দিকটি আমরা দেখি , যার কারণেই
কঠিন শব্দ হারিয়ে যায় । সংস্কৃত থেকে মাঝের আরো পর্যায় পেরিয়ে আধুনিক বাংলায়
আমরা এসে পৌঁছেছি।
একইভাবে কাজ করে
Parreto Principle , কেননা আপনার
করা কাজগুলোর মাঝে অল্প কিছু কাজই বেশিরভাগের
জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতীয়মান হয় । তাই সে ২০% কাজই আপনার সাফল্যের ৮০%
নির্ধারণ করবে ।
নোভেল
করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ ছড়ানোর ক্ষেত্রে আমরা যে এক্সপোনেনশিয়াল ট্রেন্ড দেখতে
পাই , তার সামঞ্জস্য ১ম পর্বের “Metcalfe’s Law” : Network Strength Analysis অংশে আমরা দেখতে পাই ।
শুরুতে
১ জন থেকে ২ জন দিয়ে শুরু হলেও খুব দ্রুতই
শতকের ঘর , তার চেয়েও দ্রুত হাজারের ঘর ছুঁয়ে ফেলা এই ভাইরাস ছড়িয়েছে ত্বরিৎ গতিতে
। ১ জন মানুষ
যতজনের সংস্পর্শে আসেন , ১০ জন তার চাইতে অনেক বেশি মানুষের স্পর্শে আসবেন – এটাই
স্বাভাবিক আর এই কারণে ছককাগজে বেশ খাড়াভাবেই বেড়েছে সংক্রমণের হার।
প্রায়
একই হারেই কিন্তু এটি কমে আসবে বলে গানিতিক মডেল অনুযায়ী দাবি করা হয় । এখানেই চলে আসে রিসোর্স স্বল্পতার প্রেক্ষাপট ।
সাধারনের মাঝে ইম্যুনিটি তৈরী হয়ে যাওয়ায় এই ভাইরাস তখন রিসোর্সের সংকটে পড়ে
যাচ্ছে আর তার বৃদ্ধিও নেমে আসছে।
ঠিক
এই ঘটনাটি জনসংখ্যার ইস্যু তেও দেখা যায় । ব্যাক্টেরিয়ার মতো অণুজীব সূচকীয় হারে
সংখ্যাবৃদ্ধি করে। ৭ ঘন্টার মধ্যেই
১টি ই.কোলাই ব্যাক্টেরিয়া্ম থেকে ২০ লক্ষ নতুন ব্যাক্টেরিয়া
হতে পারে। তবে বাঁধ সাধে খাদ্য , স্থান ইত্যাদির সংকট । অনুকূল পরিবেশ না পেলে এই
বৃদ্ধি স্তিমিত হয়ে আসে । এক্সপোনেনশিয়াল গ্রোথের এই শর্ত নিয়েই তাই চলে আসে
“লজিস্টিক ইক্যুয়েশন” ।
যাই
হোক , জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে “Carrying Capacity”
(ধারণক্ষমতা) এর উপর ভিত্তি করেই
অনুমান করা হয় যে কোন জীব সর্বোচ্চ কতটুকু সংখ্যাবৃদ্ধি করবে। এই ধারণক্ষমতার সংকটই মূলত এক্সপোনেনশিয়াল বৃদ্ধির উপর শর্ত জুড়ে
দেয় এবং লাগাম টেনে ধরে সেই বৃদ্ধির উপর।
এই
দুপর্বের আলোচনার, ১ম পর্বে উঠে এসেছে Pareto
Principle, Zipf’s Law , Price’s Law , Metcalfe’s Law এর মতো গানিতিক মডেল সমূহ এবং
তাদের বাস্তবিক বা প্রায়োগিক আলোচনায় আমরা দেখতে পাই , সূচকীয় বৃদ্ধি কতটাই সাধারণ
। আর ২য় পর্বে আমরা পরিচিত লাভ করি এই বৃদ্ধির স্বাভাবিকতার সাথে। সূচক নিয়ে
এভাবেই দিনের পর দিন আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। মাত্র দুই পর্বের ক্ষুদ্র ব্লগ
দিয়ে কাউকে সূচক সম্পর্কে অনেক জানানো মূল উদ্দেশ্য ছিলোনা , বরং লক্ষ্য ছিলো সূচক
সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরী করা।
মোহাম্মদ ইফতেখার
ইবনে জালাল (ইফতু)
তড়িৎ ও ইলেক্ট্রনিক
কৌশল বিভাগ,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ।









No comments